মানুষ চিরকালই রহস্য প্রিয়। কখনো নিজেই রহস্যএখনো পর্যন্ত কারো এখানে প্রবেশ করার ময় হয়ে ওঠে আবার কখনো রহস্য উদঘাটনে ব্যতিব্যাস্ত থাকে। তবে রহস্যের অন্তরালে নিজেকে লুকিয়ে রাখার মানুষের এই প্রবণতা খুব সম্ভবত তাকে কালজয়ী করে তোলে। এই ধরনেরই মানব সৃষ্ট রহস্য নিয়ে আজকের পর্ব : " দ্য মিষ্টিরিয়াস এরিয়া - ৫১"
এরিয়া ৫১ বিশ্বের কাছে এটি মার্কিন সরকারের এক বিশাল সামরিক বাহিনীর অপারেশন ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও অনেকে এটিকে "এরিয়া অফ কন্সপেরেসি" অথবা 'ষড়যন্ত্রের এলাকা' বলে থাকে। ধারণা করা হয়, কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমেরিকা লোকচক্ষুর অন্তরালে উন্নত মানের যুদ্ধ বিমান এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরির গবেষণা এবং পরীক্ষা চলতো এ অঞ্চলে। জায়গাটিতে জনসাধারনের প্রবেশ নিষেধ হলেও 'ন্যাশনাল জিওগ্রাফি' এ অঞ্চলের কিছু ছবি প্রকাশ করে। একটা ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৫০ এবং ৬০সালের দিকে অক্সকার্ট নামে একটা প্রকল্পের আওতায় তৈরি হয় A-12 বিমান। এই বিমানটি ছিল U-2 নামের একটি স্পাই বিমানের উত্তরসূরী এবং বর্তমান SR-71 BLACKBIRD স্পাই বিমানের পূর্বরুপ। বিমানটির বিশেষত্ব ছিলো, এটি রাডারের হাতে চিহ্নিত না হয়ে ঘন্টায় ২২০০ মাইল (৩৫৪০কিমি) বেগেউড়বার ক্ষমতা ছিল। ৯০০০০ হাজার ফুট উপর থেকে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরার মাধ্যমে মাটিতে থাকা ১ফুট দৈঘ্য সমান বস্তুর ছবি তোলার ক্ষমতা ছিল এই বিমানটির। কিন্তু আমেরিকার সরকার একে আরো উন্নত করতে গিয়ে এক বিশাল দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে। দ্রুতহস্তক্ষেপের কারণে সরকার ব্যাপারটি লুকিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। পরীক্ষামূলক বৈমানিক কেন কলিন্স (এরিয়া-৫১ এ যার ছদ্মনাম কেন কলমার) ন্যাশনাল জিওগ্রাফীকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান ওই দিনের ঘটনা। তিনি ওই দিন বিমানটির পরীক্ষামূলক উড্ডয়নে সম্পৃক্ত ছিলেন। হঠাৎ সব কিছু উলোটপালোট হয়ে পড়ে যখন তিনি খুব লো অ্যাল্টিচ্যুড এ বিমানের সাবসনিক ইঞ্জিনটিকে পরীক্ষা করতে শুরু করেন। ২৫০০০ ফিট উচ্চতায় আকস্মিকভাবে বিমানের মাথা উপরের দিকে উঠতে থাকে তারপর উল্টে যায় এবং অনুভূমিক ঘুরতে শুরু করেন। এ ধরণের পতনের হাত থেকে উড়োজাহাজকে রক্ষা করবার উপায় নেই। আর তাই তিনি বের হবার সিদ্ধান্ত নেন। প্যারাসুটের মাধ্যমে যখন মাটিতে নামতে সামর্থ হন তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন স্থানীয়দের বেশে তিনজন লোক তার জন্য পিকআপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরা কলিনকে ধ্বংসাবশেষের কাছে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু কলিন
তাদেরকে নিয়ে উল্টো পথে রওনা দেন এবং তাদের জানান যে বিমানে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে-এর কারন এই ধরণের গল্প আগে থেকেই তৈরি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি কর্মকর্তারা একটু পরে এসে জায়গাটি পরিস্কার এবং ধামাচাপা দেবার কাজ শুরু করে। পরের দিন সকালের আগেই সমস্ত ধ্বংসাবশেষ একটা ট্রাকের মাধ্যমে এরিয়া ৫১তে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তী অর্ধশতকের মধ্যে কেউ এই
জায়গাটিতে আর আসেনি। তবে অ্যারোস্পেস বিশেষজ্ঞ পিটার মারলিনের মতে ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ ডায়নামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার চিন্তা ভাবনা ছিল যাতে কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে তা চিহ্নিত করা সম্ভবনা হয়। আজ এ ঘটনাকে লুকিয়ে রেখে আর কোন সুবিধা পাওয়া যাবে না বিধায় সিআইএ এই ছবিগুলো প্রকাশ করেছে বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ ডেভিড রবার্জ। ২০০৭ সালে অক্সকার্ট প্রকল্প সংক্রান্ত অনেক তথ্য প্রকাশ পায়। এর মধ্যে ছিলো এয়ার ফোর্সের কাছ থেকে নয়টার মধ্যে থেকে একটা এ-১২ বিমান তারা অধিগ্রহন করেছে যা এখন সিআইএ-র প্রধান কার্যালয়ে শোভা পাচ্ছে। যদিও সিআইএ ঘটনার কিছু ছবি প্রকাশ করেছে তথাপি এ ব্যাপারে কারা জড়িত ছিল বা কিভাবে এটি সম্পন্ন হলো সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি। অ্যারোস্পেস ঐতিহাসিক পিটার মারলিন, দুর্ঘটনার জায়গাটি কয়েকবার প্রদর্শন করেছেন। তার মতে, এ-১২ এর ফিউজলাজ এবং পাখা ব্লো-টর্চ দিয়ে কেটে আলাদা করে ট্রাকে তোলা হয়, সাথে তোলা হয় লেজ এবং আর যে সকল বড় বড় যন্ত্রাংশ ছিল সেগুলোকে। পড়ে থাকা ছোট ছোট যন্ত্রাংশগুলোকে বাক্সে ভরা হয়েছিল। পরিস্কার করার আগে যাতে কোন বিমান থেকে কিছু দেখা না যায় তাই তারপুলিন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। যখন দুর্ঘটনাটা ঘটে তখন অক্সকার্ট প্রকল্পটি খুব গোপনীয় প্রকল্প ছিলো, এটি প্রকাশ হলে আমেরিকার শত্রুরা বিকল্প বা প্রতিরোধের
ব্যবস্থা নিয়ে ফেলতো তাই সরকার এ ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টাইটানিয়ামের টুকরো আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিদিকে। পিটার মারলিন জানান, এলাকা ঘুরে এ ধরনের
অনেক টুকরা তিনি দেখতে পেয়েছেন। তিনি এখানে বিমানের পাখা এবং ককপিটের কিছু অংশও পেয়েছেন যাতে এখনো 'স্কাঙ্ক অয়ার্ক্স' এর ছাপ দেয়া আছে। স্কাঙ্ক অয়ার্ক্স ছিল প্রতিরক্ষা বিভাগের একটা ভাগ।
রহস্যময় এই জায়গাটিকে ঘিরে বিতর্কের অন্ত নেই। অনেকের দাবী এরিয়া-৫১ এ ফ্লাইং সসারের মত মত কিছ উড়তে দেখা গেছে। আবার অনেকেই নাকি এমন দ্রুতগতির বিমান উড়তে দেখেছেন যার গতি সাধারন বিমান বা যুদ্ধবিমান কোনোটার সাথেই মিলে না। তবে সব থেকে বড় ও বিতর্কিত বিষয়টি উঠে আসে এরিয়া-৫১ এ কর্মরত পদার্থবিজ্ঞানী বব লেজারের এক বক্তব্যে। এক টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ওখানে এমন কিছু মৌলিক পদার্থ নিয়ে গবেষনা করা হয় যা এখনও আবিষ্কারের ঘোষনা দেওয়া হয় নি। তিনি অবশ্য কিছু ধোয়াটে বক্তব্য দিয়েছেন একটি মৌলিক পদার্থ নিয়ে। তারমতে সুপারনোভা বা বাইনারি স্টার সিস্টেম থেকেই সম্ভবত একটি মৌল সংগ্রহ করা হয়েছে। যার মাত্র ২.২ পাউন্ড ৪৭টি ১০মেগাটন হাইড্রোজেন বোমা বানানোর জন্য যথেষ্ট। ওখানে নাকি এমন একটি সরল যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছে যা চাকতি আর বল দিয়ে তৈরী। যন্ত্রের বলের চিপে ঐ মৌলটি রাখা হলে সময়কে স্থির করে রাখা যায়। এই বিষয়ে পরীক্ষা চালিয়ে সফলতাও এসেছে। তার মতে ঐ মৌল পদার্থটি বলের চিপে রাখামাত্র তা কোন এক প্রক্রিয়ায় অ্যান্টিম্যাটার তৈরী করে এবং তারফলে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদিত হয়। অ্যার্টিম্যাটার রিয়েক্টরে শক্তি উৎপাদনের ফলে বস্তুর নিজস্ব মহাকর্ষ বলের সৃষ্টি হয় এবং নিজস্ব শক্তিতে তা বিদুৎবেগে ছুটতে পারে। এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওখানে ফ্লাইং সসার তৈরীর গবেষনা চলছে। তবে বব সবচেয়ে বড় ধাক্কা দেন এই বলে যে সেখানে নাকি ভীনগ্রহীবাসীদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি ফ্লাইং সসার আছে। আর ওই ধবংস হয়ে যাওয়া ফ্লাইং সসার থেকে প্রাপ্ত মৃত এলিয়েনটির ব্যবচ্ছেদ করা হয়। তারা জানতে পারে, ঐ প্রাণীটি এসেছে রেটিকুলাম-৪ নামক জ্যোতিষ্ক থেকে। প্রাণীটির উচ্চতা সাড়ে তিনফুট। লোমহীন শরীর কালো বড় বড় চোখ এবং শরীর কৃশকায়। দেহ ব্যবচ্ছেদ করে ফুসফুস ও হৃৎপিন্ডর বদলে বিশাল এক পতঙ্গ পাওয়া গেছে। এ বিতর্কের এখানেই শেষ নয়। এরিয়া৫১ নিয়ে চলমান বিতর্কের সবচেয়ে বড়টি হল মানুষের চাঁদে যাওয়া নিয়ে। অনেকের ধারনা মানুষ কখনও চাঁদে যায়নি। বরং পুরো নাটকটি সাজানো হয়েছে এই এরিয়া-৫১ এর ভিতর। মজার ব্যাপার হচ্ছে এত বিতর্ক চললেও আমেরিকান সরকার এসব কোনোকিছুই স্বীকার করেনি আজপর্যন্ত। তাতে সন্দেহ না কমে বরং আরো বেড়েছে।
এরিয়া-৫১ এর আয়তন ২৬,০০০ বর্গকিলোমিটার। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে এবং লাস ভেগাস থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম রেকেল নামক এক গ্রামের কাছে অবস্থিত। এর দক্ষিনে রয়েছে গ্রুম হ্রদে। বিভিন্ন সুবিধার্থে এই স্থানটিকে "দ্য ড্রী ল্যান্ড বা স্বপ্নের ভূমি", " দ্য রেকেল অফ হেভেন বা বেহেশ্তের রেকেল" হিসাবেও জানা হয়। স্থানটির চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া আছে। বিমানচালকরা বেড়ার চারিদিকের আকাশ সীমাকে 'বক্স' বলে ডাকে। ২০০৯ সালে অবসর প্রাপ্ত বিভিন্ন কর্মকতারা যাদের এরিয়া ৫১-তে কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল বলে দাবী করে তাঁরা বলেন, এরিয়া ৫১ উন্নতিসাধন এবং সাম্প্রতিক প্রযুক্তি (সামরিক জেড প্লেন, মডিউল, ইত্যাদি) পরীক্ষণের কাজে গোপনীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়। এরিয়া-৫১ এ মোট সাতটি বিমান উড্ডয়নের পথ আছে তার মধ্যে এখন একটিকে বন্ধ বলে মনে হয়।। সম্পূর্ন এলাকাটি নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার বেষ্টনীতে ঢাকা। প্রবেশাধীকার নিষিদ্ধ এবং "স্যুট এট সাইট " অর্ডার সম্বলিত। আজ পর্যন্ত কোন সাধারনের সেখানে প্রবেশের কথা শোনা যায় নি। তবে যদি কেউ প্রবেশ করেও থাকে তাহলে সে ফিরে আসে নি।
এই প্রবন্ধটি পোস্ট করা হয়েছে: July 26, 2013