মানব সভ্যতার ইতিহাস শুধু বিশালই নয় বরং জটিল, অদ্ভূত , এবং রহস্যময়। এই সুবিশাল ইতিহাসের কিছু অংশ যা আমরা ভুলে যাই; কালের বিবর্তনের সাথে সাথে সেগুলো আমাদের কাছে নতুন প্রশ্ন নিয়ে আসে। আমরা আজ এখানে পুনরায় সেই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হবো। ফিরে তাকাবো সেই ছেড়ে আশা অবিচ্ছেদ্য স্মৃতির দিকে যা আজও আমাদের থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করে। তবে আমরা এখানে কোন উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো না। সে বিষয়টি একান্তই ব্যাক্তিগত।
এখানে ধারাবাহিকভাবে পৃথিবীর কিছু অমীমাংসিত সত্যতার সাথে পরিচিত হবো। আজকের পর্বটি হচ্ছে , "দ্য মিষ্টরি অফ ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট।"
২৮ শে অক্টোবর, ১৯৪৩। যুক্তরাষ্টের পেনসালভেনিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়া নামের ছোট একটি এলাকা। পৃথিবীব্যাপী তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ডামাডোল বাজচ্ছে। ইউএস নেভির একটা ঘাঁটি এখানে।" ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস এল্ড্রিজ " নামে বিধবংসী এক যুদ্ধ জাহাজকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। না , কোন যুদ্ধের জন্য নয়। একটি বিশেষ ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। উদ্দেশ্য শত্রু সীমানায় প্রবেশ করে জাহাজকে কিভাবে অদৃশ্য করে চোখ ফাঁকি দেয়া যায়।
এই উদ্দেশ্যকে সফল করতে ব্যবহৃত হয় আইনেস্টাইনের "ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি"। এই থিওরি অনুযায়ী কোন স্থানে আলোকে যদি কোনভাবে এমনভাবে বন্দি করে রাখা যায় যে সেখান থেকে আলো বেরুবে না বা প্রবেশ করতে পারবে না তাহলে ওই স্থানে পৃথিবীর সময়কেও থামিয়ে দেয়া সম্ভব। ফলে ঐ নির্দিষ্ট স্থানে মহাকর্ষ বলের কোন প্রভাব থাকবে না। আইনেস্টাইনের এই থিওরির কোন ব্যাবহারিক বা প্রায়োগিক প্রমাণ নেই। কিন্তু কিছু গবেষক মনে করেন যে এই থিওরির মাধ্যমে কোন বিশেষ ইলেকট্রিক্যাল জেনারেটর ব্যবহার করে কোন নির্দিষ্ বস্তুর চারপাশে একধরনের তড়িৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে ঐ বস্তুর চারপাশের আলো আটকে রাখা সম্ভব। এতে করে ওই বস্তুটি কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাবে। সে সময় সেনাবাহিনী বেশ এই বিষটিতে গুরুত্ব দিয়েছিল। কারণ তারা যেকোন ভাবে সাফল্য চাইত। তাই সম্ভাব্য সকল উপায়ই তারা অবলম্বন করত। এবার মূল ঘটনায় আসা যাক। নির্দিষ্ট জায়গায় এবং নির্দিষ্ট সময়ে ইউএস নেভি তাদের ডেস্ট্রয়ার এল্ড্রিজকে প্রস্তুত করে অদ্ভুত এই পরীক্ষার জন্য। এই প্রোজেক্টের নাম রাখা হয় " প্রোজেক্ট রেইনবো"। চারপাশে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বসানো হয়। তারপরে শুধু রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। সবাই চেয়ে আছে পরের বিস্ময়ের জন্য। প্রথম কয়েক সেকেন্ড তেমন কিছুই ঘটল না। কিন্তু তারপর হঠাৎ এল্ড্রিজের চারপাশে নীলাভ আলোর আভা ফুটে উঠল। একসময় সেটা গাঢ় হয়ে স্পষ্ট হলো। তারপরেই ঘটল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেলো এল্ড্রিজ। শুধু চোখের সামনেই অদৃশ্য হল না, বরং জায়গাটি থেকেই অদৃশ্য হয়ে ২০০ মাইল (৩২০ কিমি ) দূরে নরফোক, ভার্জিনিয়াতে পৌছে গেলো। সেসময় নরফোকের ওই জায়গায়" এসএস আন্ড্রু ফুরসেইথ " নামে আরো একটা জাহাজ ছিলো। এল্ড্রিজ ওই জাহাজটির সামনে গিয়ে কিছুক্ষনের জন্য উপস্থিত হয়। ফুরসেইথের অনেকেই তখন এল্ড্রিজকে দেখতে পায়। এরপর জাহাজটি পুনরায় য ফিরে আসে তার পরীক্ষার স্থানে। এই সব ঘটে শুধুমাত্র ১০ সেকেন্ডের মধ্যে। আরেকটা তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় এই পরীক্ষাটি আরো একবার করা হয়েছিলো ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরে। সেদিন ব্রুকলিন নিউইয়র্ক নেভি ইয়ার্ডে জনমানবহীন একটা নৌযান এই পরীক্ষনের জন্য ব্যাবহার করা হয়। যা সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায় এবং পুনরায় কিছুক্ষনের মধ্যে স্বস্থানে ফিরে আসে। অদৃশ্য হবার সময় এর চারপাশে তখন সবুজাভ ধোঁয়া সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেদিন নৌযানটি শুধু ওই স্থান থেকেই অদৃশ্য হয়। অন্য কোথাও তাকে দেখা যায় নি। এরপর নৌবাহিনীর অনুরোধে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সরকার গবেষনাটিতে বিশেষ উৎসাহ দেখান। অতপর অক্টোবর ২৮,১৯৪৩ সালে পুনরায় পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তবে এবার ক্রুসহ। তারপর ভয়ঙ্কর যে বিষয়টি ঘটে তা হচ্ছে এল্ড্রিজ ফিরে আসার পর। ক্রুদের সাইড ইফেক্ট ছিল প্রচণ্ড রকমের। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে, অনেকে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যায়। অনেকে আবার পাগল হয়ে যায়। সত্য কোন ভিত্তি নেই, কিন্তু অনেকেই বলে সেদিন নাকি কারো কারো শরীর গলে জাহাজের ইস্পাতের সাথে লেগে গিয়েছিল আবার কেউ কেউ নাকি আজও ফিরে আসেনি। পরবর্তীতে এরা সবাই নিখোঁজদের দলে নাম লেখায়। এমনও শোনা যায় যে কিছু ক্রু নাকি এই ঘটনার পর কিছু অবিশ্বাস্য ক্ষমতা লাভ করেন, যেমন যে কোন কিছু ভেদ করে চলে যাবার ক্ষমতা বা হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। এই বিষয়ে লোকমুখে একটা গল্প আছে। ঐ ঘটনায় যেসব নাবিক বেঁচে ছিলো তাদের মধ্যে একজন এক সন্ধ্যায় তার পরিচত কোন ব্যাক্তির সাথে রেস্তোঁরায় বসে ছিলো। হটাৎ সে যেসব নাবিক ঊঠে রেস্তোঁরার দেয়ালের দিকে হাঁটা শুরু করে তারপর একসময় দেয়ালের সাথে মিলে যায়। সরকার পুরো বিষয়টিতে যথেষ্ট গোপনীতা অবলম্বন করেছিল। এই পরীক্ষার পর যারা বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিল তারা স্বীকার হয় ব্রেইনওয়াশের, যার ফলে তাদের অনেকেরই পরবর্তীতে এই পরীক্ষার কথা আর মনে ছিল না।
ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট পরবর্তীতে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই আলোড়নের নেপথ্যে যে ছিলেন তার নাম " এড ক্যামরন "। তিনি ইউ এস নেভিতে ল্যাফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন ১৯৩৯ সালে। পরে তাকে জেনারেল ড. ভন নিউম্যান এর নেতৃত্বাধীন প্রোজেক্ট রেইনবোতে রিক্রুট করা হয়। সেখানে তিনি আইনিস্টাইন এবং টেসলার সাথে পরিচিত হোন। দুটো পরীক্ষার সময় তিনি সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। পরে তাকে লস এবামা নেশ্যানাল ল্যাবরটরিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সরকারের নজর তার উপর বিদ্যমান ছিলো। তিনি রেইনবো প্রোজেক্টের বিষয়ে স্থানীয় একটা পত্রিকা মাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন। এই ঘটনার কয়ে বছরের মধ্যে তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায় এবং ঐ পত্রিকাটি নিষেদাজ্ঞা জারী করে বন্ধ করে দেয়া হয়। এই ঘটনার পর অনেকেই বিষয়টি নিয়ে উৎসাহ দেখায়। তাদের মধ্যে মরিস কে জেসপ ছিলেন অন্যতম। এই এক্সপেরিমেন্টের কথা কোনদিনই সরকারিভাবে স্বীকা করা হয় নি। কিন্তু কথাগুলো বেফাঁস হয়ে গেলে সাধারনের মাঝে গুঞ্জন সৃষ্টি হয়। লেখালেখি শুরু হয় সমসাময়িক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বইপত্রে। সবাই এর সত্যতা জানতে চায়। আস্ট্রোফিজিসিস্ট, আস্ট্রোনমার, ম্যাথমেটিশিয়ান, রাইটার এবং এক্সপ্লোরার মরিস জেসপ এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি ইউনিফাইড ফিল্ড ত্থিওরি এবং প্রোজেক্ট রেইনবোকে ঘিরে অনেক রহস্যের সমাধানের পথ খুঁজে বের করেন। একসময় সমাধানের কাছাকাছি পৌছে যান। তারপরেই ঘটে একটা আজব বিষয়। তিনি হঠাৎ করেই তার গবেষণা বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে তিনি এর কারন হিসেবে এক অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ দেন। ১৯৫৬ সালের ১৩ জানুয়ারী জেসপ হঠাৎ একটা অদ্ভুত চিঠি পান কার্লস মিগুয়েল এলেন্ড নামক একজনের কাছ থেকে।এলেন্ড ছিলেন ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি নাবিক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এলেন্ড জেসপকে একটা চিঠি লেখেন। যেখানে তিনি তাকে ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি নিয়ে আর কাজ না করতে অনুরোধ করেন। আলেন্ড তার চিঠিতে লিখেছেন " ১৩ বছর আগে মহাকর্ষ আর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম নিয়ে ইউ এস সরকারের গবেষণার ফলাফল ছিল ভয়াবহ।' কিন্তু এলেন্ড কেনো নিষেধ করেছিলেন তার কারন আজও জানা যায়নি। জেসপ এই ঘটনার পর আর কখনো এই বিষয়ে কোন কথা বলেন নি। ধারনা করা হয় জেসাপ এই বিষয়ে এমন কিছু যানতেন যা হয়তো বা মানব সভ্যতার ধারাবাহিকতাকে থমকে দাঁড় করাতে পারে অথবা এমন কিছু যা আমাদের চিন্তার বাইরে অবস্থিত অবিশ্বাস্য সত্য। রেইনবো প্রোজেক্টের পর পরই আইনিষ্টাইন তার ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরিকে প্রত্যাখান করেন। পরে সরকারি ভাবে এই প্রোজেক্ট এবং থিওরিটিকে নিষেধ করে দেয়া হয় আজও বিদ্যমান। তাই আজ বিজ্ঞানের কোথাও এই ঘটনার বিবরন পাওয়া যায় না। কিন্তু ইতিহাস সেটা ভুলে যায় নি। হয়তো বা ভবিষ্যতে এই বিস্মৃত রহস্য তার সমাধান নিয়ে ফিরে আসবে।
এই প্রবন্ধটি পোস্ট করা হয়েছে: July 17, 2013